শনিবার, ২৬ অক্টোবর, ২০২৪

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের গ্রোয়েনে বাধা, নতুন গতিপথে পদ্মার ভয়াল আগ্রাসন

 রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের গ্রোয়েনে বাধা, নতুন গতিপথে পদ্মার ভয়াল আগ্রাসন 

 

একে একে সব নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। বছরখানেক আগেও যে নদী দুই কিলোমিটার দূর দিয়ে ছিল সেই নদী এখন বাড়ির উঠানে চলে এসেছে। কৃষিজমি-জমা সবই চলে গেছে নদীর পেটে। বাড়ির গাছপালা, টিউবওয়েল, বাথরুম সবই চলে গেছে। শুধু উঠানটা রয়েছে, পাকা ঘরটাও ভেঙে গেছে। যেকোনো সময় উঠানও চলে যাবে নদীর পানিতে। সব হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছেন কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার তালবাড়িয়া ইউনিয়নের সাহেবনগর এলাকার কৃষক খলিলুর ও শিল্পি দম্পতি।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের গ্রোয়েনে বাধা পেয়ে নতুন গতিপথের সন্ধানে প্রমত্ত পদ্মার ভয়াল আগ্রাসনে ভাঙছে নদীর ডান পাড়, ফলে বর্তমানে বিপন্ন হয়ে পড়েছে ওই জনপদ। ইতোমধ্যে সরকারি বেসরকারি জনগুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও অবকাঠামো বিলীন হয়েছে পদ্মার গর্ভে। পদ্মার ডানপাড়স্থ কুষ্টিয়া মিরপুর উপজেলার বহলবাড়িয়া ও তালবাড়িয়া দুই ইউনিয়নের ৭ কিলোমিটার এলাকায় প্রবল ভাঙনে কৃষিজমি, বাড়িঘর, স্কুল মাদরাসা বিলীন হয়েছে ইতোমধ্যে।


সম্প্রতি জাতীয় বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের কয়েকটি টাওয়ার ভেঙে পড়েছে নদী গর্ভে। এছাড়া উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার সঙ্গে সংযুক্ত একমাত্র মহাসড়কটিও চরম ঝুঁকিতে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাবাসীর দাবি অবিলম্বে এই ভাঙন ঠেকাতে স্থায়ী তীররক্ষা বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নসহ মনুষ্যসৃষ্ট এই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী কথিত বিশেষজ্ঞদের জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসার দাবিও তাদের।

তবে সংশ্লিষ্ট পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, নদীর পানি কমার সঙ্গে সঙ্গেই প্রকল্প বাস্তবায়নে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করবে।

আক্রান্তরা বলছেন জমি-জায়গা যা ছিল সবই গেছে। এখন মাথা গোঁজার ঠাঁইও হারিয়েছেন, সর্বস্বান্ত হয়ে তারা অবস্থান এখন আশ্রয়হীন ভাসমানদের দলে। মহামারি এই ভাঙন ঠেকাতে স্থায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি তাদের। তাৎক্ষণিক জরুরি ভিত্তিতে বালুর বস্তা দিয়ে অস্থায়ীভাবে ঠেকানোর চেষ্টাতেও সুফল ক্ষীণ। ফেলানো জিও ব্যাগ সবই গভীর পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অদূরদর্শী, অবহেলা ও অদক্ষতায় দেশের অন্যতম বৃহত্তম পদ্মা নদীর গতিপথ পরিবর্তনের ঘটনা ঘটেছে। এর ফলে নদীর ডান পাড়ের এলাকায় পরিবেশ বিপর্যয়সহ গোটা জনপদ চরম ঝুঁকির মুখে দাঁড়িয়েছে।


হার্ডিঞ্জ রেলসেতু ও লালন শাহ সড়ক সেতুর লাগোয়া ভাটিতে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের পোর্ট নির্মাণে পদ্মা নদীর বাম তীর থেকে মূল প্রবাহ চ্যানেলের মধ্যে প্রায় ৫শ মিটার দৈর্ঘ্যের গ্রোয়েন (বাঁধ) নির্মাণের কারণে নদী হারিয়েছে প্রকৃত গতিপথ। এতে পদ্মা নদীর ডান তীরে দেখা দেয় তীব্র ভাঙন।

স্থানীয় ভুক্তভোগীরা দায় দিচ্ছেন নদী ও পানিসম্পদ বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। তাদের দাবি গ্রোয়েন নির্মাণ প্রকল্পের সঙ্গেই পদ্মা নদীর সম্ভাব্য প্রবাহ চ্যানেলের গতিবিধি শনাক্ত করে ডান তীরে মাত্র দুই কিলোমিটার প্রতিরক্ষা বাঁধ দিলে সুরক্ষিত থাকতো নদীর গতি প্রকৃতি ও সমগ্র জনপদ, লাঘব হতো সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের বোঝা।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কুষ্টিয়া কর্তৃপক্ষের দাবি রূপপুর গ্রোয়েনের কারণে পদ্মা নদীর ডান তীরে সৃষ্ট ভাঙন এলাকার সুরক্ষা বা তীর রক্ষায় প্রায় ৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের অনুমোদিত উন্নয়ন প্রস্তাবনা বাস্তবায়নে দরপত্র প্রক্রিয়া ও কার্যচুক্তি পূর্ব কার্যক্রম চলছে। তবে অনুমোদিত প্রকল্প এলাকা বহির্ভূত উজানে আরও প্রায় ৫ কিলোমিটার এলাকায় আবার নতুন করে ভাঙন দেখা দিয়েছে।


শিল্পি খাতুন বলেন, আর কত কাঁদবো? কোথায় গিয়ে কাঁদবো। সব শেষ হয়ে গেছে। নদী ভাঙতে ভাঙতে সব ভেঙে ফেলেছে। ঘরবাড়ি সব হারিয়ে গেছে। এখন কোথায় গিয়ে থাকবো। একদিনের মধ্যেই সব শেষ হয়ে গেলো।

খলিলুর জানান, জায়গা জমি সব গাংয়ে চলে গেছে। আর এক কাঠার মতো জমি আছে। সেটাও চলে যাবে মনে হচ্ছে।

ষাটোর্ধ্ব ভুক্তভোগী এক নারী বলেন, ঢালাই এর রাস্তা ছিল। এক রাতের মধ্যে সেই রাস্তা নদীতে চলে গেছে। আমার ১০ বিঘা জমি ছিল সেটাও এখন নদীর ভেতর চলে গেছে। এখন বাড়িটুকু ছাড়া আর কিছু নাই। ছাওয়ালরা (ছেলে) কি করে খাবে সেটা আল্লাহ জানেন। যদি বাড়িটা থাকে তাহলে থাকতে পারবো আর সেটাও চলে গেলে কোথায় গিয়ে থাকবো।

স্থানীয় ভুক্তভোগী ডা. আব্দুল মোমিনের দাবি, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের পোর্ট নির্মাণে পদ্মা নদীর বাম তীর থেকে মূল প্রবাহ চ্যানেলের মধ্যে প্রায় ৫শ মিটার দৈর্ঘ্যের গ্রোয়েন (বাঁধ) নির্মাণের কারণে নদীর ডান তীরে ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে। এজন্য ওই প্রকল্পের কিছু কর্মকর্তাদের ভুল সিদ্ধান্ত দায়ী। এ ব্যাপারে বিভিন্ন মহলে ও দপ্তরে আমরা একাধিকবার জানিয়েও কোনো কাজ হয়নি। এছাড়া মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করেছি। এখন আমাদের ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। এর কারণে আমাদের এই এলাকার অনেক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া আগামীতে এ ভাঙনের ফলে আমরা সবাই নিঃস্ব হয়ে যাবো। পানি উন্নয়ন বোর্ড স্থানীয় কোনো সমাধান না করে বালুর বস্তা ফেলছে যার তেমন কোনো ফল আসছে না।


স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্ত এক ভুক্তভোগী জানান, সবই হবে, বাধ নির্মাণ হবে, নদীর ভাঙন রোধ হবে কিন্তু আমাদের শেষ করেই হবে। ততদিনে আমরা হয়তো সব হারিয়ে ফেলবো।

নদী ভাঙনের ঝুঁকিতে থাকা মীর আব্দুর করীম কলেজের অধ্যক্ষ আহসানুল হক খান চৌধুরী বলেন, হঠাৎ ভাঙন যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তাতে যেকোনো সময় কলেজটিও নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া কুষ্টিয়া-পাবনা মহাসড়কও বিলীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এজন্য সরকারের কাছে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ করছি।

পানি উন্নয়ন বোর্ড কুষ্টিয়া নির্বাহী প্রকৌশলী রাশিদুর রহমান জানান, পদ্মার ডান তীরের এই অংশে পুরো স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে এবং ঘুর্ণনের ফলে ভাঙন দেখা দিচ্ছে। ইতোমধ্যে আমরা ভাঙন রোধে জিও এবং টিউব দিয়ে প্রাথমিক ভাঙন রোধে চেষ্টা করছি। স্রোত ও গভীরতা বেশি হওয়ায় জিও বস্তা ও টিউব দিয়ে ভাঙন রোধ দুরূহ হচ্ছে। যেন মানুষের ক্ষতি না হয় এজন্য চেষ্টা করছি। আমরা ৭০০ মিটার ভাঙন এলাকায় ৫০ হাজার জিও ব্যাগ এবং ৫৫০টি টিউব ফেলছি। তাৎক্ষণিকভাবে এটা টেকসই না। তবে আমরা ভাঙন রোধে স্থায়ী পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য একটি প্রকল্প তৈরি করেছি। যা ইতোমধ্যে ঠিকাদার নিয়োগ পর্যায়ে রয়েছে।

পদ্মার ডান তীরে ভাঙন কবলিত ৯ কিলোমিটার এলাকায় স্থায়ী বাঁধ নির্মাণে ১ হাজার ৪৭১ কোটি টাকা প্রাক্কলন ব্যয় ধরে অনুমোদনপ্রাপ্ত উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ এই অর্থ বছরেই শুরু হবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কুষ্টিয়া তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক আব্দুল হামিদ।

এদিকে পদ্মায় বাড়ি ঘর হারিয়ে সর্বস্বান্ত পরিবারগুলোর শেষ ভরসা স্থায়ীভাবে দ্রুত বাঁধ নির্মাণ। এছাড়া যাদের উদাসিনতার কারণে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি ভুক্তভোগীদের।


 

 


শেয়ার করুন

Author:

Etiam at libero iaculis, mollis justo non, blandit augue. Vestibulum sit amet sodales est, a lacinia ex. Suspendisse vel enim sagittis, volutpat sem eget, condimentum sem.

0 coment rios: